জীবন ডায়েরীর পাতা থেকে..... ০২।

পূর্ব প্রকাশের পর:

ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম.......

১৯৯৮ সাল প্রায় শেষের দিকে। রাতের পতিত শিশীর বিন্দু আর সকালের হালকা কুয়াশা জানাচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। বাসার সকলের সাথে রাগ করে পাঞ্জাবি আর জিন্স পরে ঘর থেকে বের হয়ে রওয়ানা হলাম অজানা উদ্দেশ্যে। সাথে নিজের জমানো ৪০০/- টাকা, মায়ের সুকেসের ড্রয়ারের তালা ভেঙ্গে সেখানে পেলাম ৫৫০/- টাকা এবং স্কুল থেকে ঔষধ পেয়েছিলাম সেগুলো বিক্রী করে পেয়েছিলাম ১৫০/- এই মোট ১১০০/- টাকা পুঁজি নিয়ে ঢাকার লঞ্চে উঠে বসলাম। খুব খারাপ লাগছিল তখন, চিরচেনা এই শহর, শহরের মানুষজন, বন্ধু-বান্ধব সবার জন্যই খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু পরিবার পরিজনের ‍প্রতি কোন টানই অনুভুত হচ্ছিল না, কারণ তারা আমার আপনজন হয়ে আমারই বিরুদ্ধে পুলিশ রিপোর্ট করেছে, তাই তাদের প্রতি মনের ভেতরে একটা ক্ষোভ অনুভুত হচ্ছিল।

কিছুক্ষণ পরেই বিকট শব্দে হুইছেল বাজিয়ে ছেড়ে দিল লঞ্চ, বুকের ভেতরটা কেমন যেন একটা অজানা কষ্টে হাহাকার করে ‍উঠল। চোখ থেকে নিজের অনিচ্ছা স্বত্বেও পানি বের হয়ে গেল। তাকিয়ে রইলাম চিরচেনা শহরটার দিকে। লঞ্চ যতই এগিয়ে চলছে আমার প্রানের শহরটাও আস্তে আস্তে চোখের সিমানা থেকে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই কিছুক্ষন পরে সূর্যটাও আমাকে ছেড়ে অস্তমিত হল। আধারে ঢেকে গেল পুরো দুনিয়া, ‍বুকের ভেতরে থাকা একটা অচেনা ব্যথা বার বার খোঁচাচ্ছিল। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ফুপিয়ে কাদতে লাগলাম। কতক্ষন কেদেছি জানি না, পিঠের উপরে কারো হাতের স্পর্সে কান্না থামিয়ে তাকিয়ে দেখি মধ্যবয়স্ক এক লোক দাড়িয়ে। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি কেন কাদছি। কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ করে অনাকাংখিত একটি বাক্য বলে ফেললাম আর সেটা হল দুনিয়াতে আমার কেহ নেই। তাই ঢাকা যাচ্ছি কাজের খোঁজে।

লোকটি মুচকি হাসি দিয়ে আমাকে তার সাথে যাওয়ার অনুরোধ করল। আমি কিছু বলার আগেই সে আমাকে হাত ধরে টেনে তুলল এবং টানতে টানতে তার সিটে নিয়ে গেল। এর পরে তার সাথে থাকা খাবার বের করে আমাকে দিল এবং সে নিজেও খেল। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে তিনি আমাকে বল্ল জাহাজের ওয়ার্কশপে কাজ করব কিনা। আমি রাজি হয়ে গেলাম। তখন সে বল্ল তাহলে আর কান্নাকাটি না করে এবার ঘুমাও। কাল সকালে আমার সাথে যাবে, লঞ্চ থেকে নেমেই আমি আগে তোমাকে কাজের স্থানে নিয়ে যাব। তোমার কাজের ব্যবস্থা করে তারপরে আমি আমার বাসায় যাব। মনে মনে খুব খুশিই হলাম। কখন ঘুমিয়ে পরেছি জানি না, সকালে ঐ লোকের ধাক্কায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। বল্ল আমরা ঢাকা এসে গেছি, তারাতারি উঠ। দেখলাম লঞ্চ ঘাটে এসে পৌছেছে এবং নোঙ্গর করার জন্য যায়গা খুজছে। লোকটি আমাকে তরিঘরি করে টেনে নিচে নেমে আসল এবং হয়ত লঞ্চের কোন এক লোকের মুঠোয় কি যেন দিয়ে আমাকে নিয়ে লঞ্চের পেছন দিয়ে একটা নৌকায় চরে ঢাকার ওপারে চলে আসল। অজানা অচেনা যায়গায় আমি তাকে পেয়ে খুব খুশিই হয়েছি। মনে মনে ভাবছি এরকম লোক আছে বিধাই দুনিয়াটা টিকে আছে।

নৌকা থেকে নেমে সে আমাকে নিয়ে একটা ডগের কাছে গেল। সেখানে গিয়ে একটা খাবার হোটেলে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা সারলাম। এরপরে সে আমাকে বল্ল এখনও তো অফিসে লোক আসে নাই তাই আমাদের সকাল নয়টা পর্যন্ত এখানে বসে থাকতে হবে। আমিও তার সাথে সায় দিলাম। কিছুক্ষণ পরে সে বল্ল, ভাতিজা... নাস্তা তো করেছি এখন একটা পান খাওয়া দরকার, তুমি এক কাজ কর ঐ দূড়ে একটা পানের দোকান আছে তুমি সেখান থেকে আমার জন্য একটা পান নিয়ে এস আর আমি একটু বাথরুম থেকে আসি। সে আমাকে পান কেনার জন্য পকেট থেকে দুইটাকা বের করে দিল। আমি পান আনতে গেলাম, কিন্তু পান নিয়ে এসে দেখি সে ওখানে নেই। মনে মনে ভাবলাম বাথরুমে আছে মনে হয়। কিন্তু পাঁচ মিনিট যায় দশ মিনিট যায় সে আর আসে না। এভাবে ঘন্টাখানেক হয়ে গেলে তার আর দেখা নেই। মনের ভেতরে কেমন যেন খটকা লাগল। দেড়ি না করে পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে দেখি টাকা নেই। তার মানে রাতে আমাকে খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পড়িয়ে কাজটা সেরে ফেলেছে। আমার টাকা দিয়েই আমাকে নাস্তা করিয়েছে এবং আমাকে বোকা বানিয়ে চলে গেছে। কি আর করার পানটি নিজেই মুখে গুজে দিলাম। কিছুক্ষন পরে মনে পড়ল আমার নিজের যে টাকাটা ছিল সেটা তো আমি আমার প্যান্টের পকেটে রেখেছিলাম। হাত দিয়ে দেখি সেটা আছে তার মানে চারশত টাকা এখন আমার সম্বল।

চলবে........

H2
H3
H4
3 columns
2 columns
1 column
Join the conversation now
Logo
Center