ডুবন্ত বেলায় একাকীত্ব...

সুস্বাগতম, বিডিকমিউনিটির সব লেখক ও পাঠকবৃন্দ।

সবাইকে শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই। দীর্ঘদিন পর এ মঞ্চে ফিরে এলাম। আজ একটি ছোট জীবন-নৈসর্গিক প্রবন্ধ লিখবো , আশা করি লেখাটি ভালো লাগবে সবার। ধন্যবাদ।

Source

সময়, নদী, বয়ে যাওয়া, জীবন। বেশ অনেকবার এ শব্দগুলোর মাঝে এসে থমকে যাই। সারাটি বেলা কেটে যায় ভেবে ভেবে যে বেশ অনেকটা সময় এ শব্দজালগুলোর মধ্যে থেকে হারিয়ে যাওয়া কোনো একটা জগতে, যেখানে শুধু নিজের খবর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। জীবনের গল্পগুলোতে কিছু সুর বাজে হৃদয়ে, কিছু ব্যথা -ছোটবড়, বিষিয়ে তোলে মনকে, আর বেশ কিছুটা সময় নিজেকে ভুলে আনমনা হয়ে বসে থাকা - ব্যস, এভাবেই শেষটা এসে যায়।

কেন জানি, সবার জীবনে হয়তো এমন একটা সময় আসে যখন বোধহয় আশেপাশের আপন মানুষগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়। রেখে যায় তাদের স্মৃতি,চোখের কোনে জল জমে, হৃদয়টা ডুবে যায় বেদনায়, হা -হুতাশ করে মন ভেঙে যায় ; হয়তো কারো জীবনে বিত্ত -বৈভবে ঠাসা আর তার চারদিকের পৃথিবীতে শুধুই শূন্যতা, রিক্ততা, অভাব, না পাওয়া, গ্লানি আর স্মৃতিকাতরতা। তখন শুধুই একাকীত্বের বেদনা, যেভাবে জীবন কেটে যায়।

আমার নিত্যদিনের কাজের ফাঁকে এক ছোট অভ্যাস হলো বদ্ধ দালানের গন্ডি থেকে বের হয়ে অপলক দৃষ্টিতে চারপাশের প্রকৃতিটাকে দেখা। তেমনি এক বিকেলে বেলা বসে হাঁটছিলাম, থেমে থেমে দীর্ঘপায়ে পথচলা। হঠাৎ নজরে এলো আমার মতো আরেকটি প্রাণী বসে আছে,একটি গল্পের বই হাতে, মোটা ফ্রেমের চশমা পরে, খানিকটা এলোচুলে, মধ্যবয়সের ছাপ কপালে স্পষ্ট, আর কিছুটা মর্মবেদনা আর কষ্টের একরাশ হতাশা চোখের ভাবে। মোবাইল ফোনটি সম্ভবত বন্ধ, আর নিশ্চিন্তে বসে আছে।

শহরের কোলাহলের বিষয় আসে যায় না, প্রকৃতি যেখানে আপন পাখা মেলে তার স্বরুপ বিলাচ্ছে আর ব্যক্তিটি তার নিজের মধ্যে তার অস্তিত্ব্য অনুভবে ব্যস্ত। আমি আর খুব সহজে তার কাছে গেলাম না বরং দূর থেকে দেখছি। চোখের পলকে দেখে কারো জীবনের অবস্থা ঠাহর করা বোধহয় সম্ভব নয়, কিন্তু আমি এতটুকু নিশ্চিত ছিলাম যে, ব্যক্তিটির হয়তো খেয়াল রাখার মতো আপন কেউ নেই। এই অনুমানটা ঐ ব্যক্তিটি আমাকে শেখাই নি, না অন্য কেউ, বরং এ তো শহুরে জীবনের এক খেলা, যেখানে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া সহজ, খুব সহজ।

প্রথমে ভাবলাম, গিয়ে দেখা করে আসি, তা না হলে হয়তো লোকটি একাকী বসে থেকে চলে যাবে, আর আমার জানা হবে না বিষয়টি। কিছুটা পথ হেঁটে হেঁটে তার কাছে পৌঁছালাম আর ব্যক্তিটি আমার উপস্থিতি টের পেয়ে বইয়ের পাতায় নিবদ্ধ চোখ তুলে এদিকে তাকাল। তাঁর চোখেমুখে অস্পষ্ট একটি শূন্যতার ভাব ; বোধহয় তাতে দীর্ঘক্ষন কারো সাথে কথা না বলার বেদনা মিশে আছে। আমি তাকে অভিবাদন জানিয়ে পাশে বসলাম। নাম-পরিচয় আর ভালো আছে কিনা - জিজ্ঞাসা করতেই দেখলাম তার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।

লোকটি তার কথায় তুলে ধরলো তার জীবনের মস্ত বড় একটা অতীত, বেড়ে ওঠা,পরিবারের কাছেপিঠে থেকে কাটানো ছেলেবেলা, নদীর পাড়ে ফেলে আসা সোনালী শৈশব -কৈশোরের দিনগুলো, আপনজনের সাথে কাটানো মূহুর্ত আর যৌবনের শেষে জীবনের সূর্য যখন মধ্য আকাশ থেকে পশ্চিম আকাশে বাঁক নিল, তারই এই সায়াহ্নে এসে, ব্যক্তিটির কথা জড়িয়ে গেল। আমি দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, হয়তো তার হৃদয়টি পুড়ে যাচ্ছিল ; কিন্তু জীবনের এমন এক মোড়ে এসে পৌঁছতে হলো যখন শুধু নিরালায় বসে দিনযাপন - এই তার ভাগ্য ছিল।

Source

এই সমাজ এগিয়ে যায় নতুন ভোরের আলো বিদীর্ণ করে,বোধহয় এতটা কষ্ট মনে পুষে রাখলে, লুক্কায়িত বেদনাগুলো অঝোরে ভেসে যায়, যখন আপনজন আর পরিবার থাকা সত্ত্বেও খোঁজ নেয় না, মানুষটি কেমন আছে। সীমাহীন ব্যস্ততা আর ব্যবসা -বাণিজ্যে ডুবে থেকে যে মানুষটিকে অন্য শহরে ফেলে এসেছে -তার সাথে হাসিখুশি, দুঃখ বেদনা, অনুভূতি প্রকাশের কোন সময় নেই তাদের। নিখাদ অর্থবিত্ত আর সম্পদের মাঝে দুদন্ড ভালোবাসা আর সৌহার্দ্য নিংড়ে পাওয়া গেল না, বাহ! এইতো জীবন।

লোকটি হয়তো খেয়েপরে দিন পার করে দিবে,হয়তো শেষটাতে কেউ খোঁজ নিবে, নয়তো নিবে না ; কোন একটা সময় মৃত্যুপথের কিনারে এসে কোন একটা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে শেষ দেখা হবে,পাথুরে মনে হয়তো দাগ কাটবে না, হয়তোবা এতটা নির্মমতা আর দূরে থাকার বেদনায় মন ভরে উঠবে না, চোখের কোনে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়বে না - শেষ চিরবিদায়ের দিন তার কথা পাষানদের মনে পড়বে না, কি করে এতটা সময় পরে এসে দেখা -মৃত্যুতে হয়তো ব্যক্তিটির মুক্তি মিললো, আপন রক্তের বন্ধন ছিন্ন করে মহাকালের যাত্রার শেষে মায়া কাটিয়ে একাকীত্ব জীবন থেকে চিরনিদ্রার চিরশান্তিতে গমন। তারপর সমাপ্তি।

H2
H3
H4
3 columns
2 columns
1 column
Join the conversation now
Logo
Center